মাতৃত্ব একটি নারীর জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই সময়টিতে মায়ের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা কেবল তার নিজের জন্য নয়, বরং গর্ভস্থ শিশুর সুস্থ ভবিষ্যতের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুষ্টিকর খাবার, নরমাল ডেলিভারির প্রস্তুতি, সন্তান প্রসবের পরবর্তী সঠিক পরিচর্যা এবং শিশুর ব্রেইন ডেভেলপমেন্ট—এই চারটি বিষয়ই নতুন জীবনের ভিত্তি গড়ে তোলে। এই লেখায় আমরা একে একে সবগুলো বিষয় বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব।

১. গর্ভবতী মায়ের পুষ্টিকর খাবার-
গর্ভাবস্থার সময় একজন মায়ের শরীরে দুটি প্রাণের চাহিদা পূরণ হয়—তাই এই সময় পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ক) প্রোটিন
প্রোটিন গর্ভস্থ শিশুর কোষ গঠন, পেশী ও অঙ্গ তৈরির জন্য অপরিহার্য। মাছ, মুরগি, ডিম, ডাল, সয়াবিন ও দুধ নিয়মিত খাদ্য তালিকায় রাখা উচিত।
খ) ক্যালসিয়াম
শিশুর হাড় ও দাঁতের গঠনের জন্য ক্যালসিয়াম প্রয়োজন। দুধ, টক দই, চিজ, কালচে শাক, তিল ইত্যাদি ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার খাওয়া উচিত।
গ) আয়রন
গর্ভাবস্থায় রক্তে হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি হলে শিশু অক্সিজেন সংকটে পড়ে। তাই আয়রনসমৃদ্ধ খাবার যেমন পালংশাক, কলিজা, আনারস, খেজুর, ডাল নিয়মিত খেতে হবে।
ঘ) ফল ও সবজি
ফল ও সবজি ভিটামিন, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও ফাইবার সরবরাহ করে। প্রতিদিন পাঁচ রঙের ফল ও সবজি খাওয়ার চেষ্টা করা উচিত।
ঙ) পানি ও তরল
গর্ভাবস্থায় ডিহাইড্রেশন মা ও শিশুর জন্য বিপজ্জনক। প্রতিদিন ৮–১০ গ্লাস পানি খাওয়া জরুরি। ডাবের পানি, ফলের রস, সুপ ইত্যাদিও উপকারী।
২. নরমাল ডেলিভারির প্রস্তুতি-
বর্তমানে সিজারিয়ান ডেলিভারির হার বেড়েই চলেছে। অথচ কিছু সহজ অভ্যাস ও সঠিক প্রস্তুতি নিলে নরমাল ডেলিভারি অনেকটাই সম্ভব।
ক) নিয়মিত হাঁটা ও হালকা ব্যায়াম
প্রতিদিন ৩০ মিনিট হেঁটে নেওয়া, বিশেষত শেষ তিন মাসে, পেলভিক মাংসপেশি শক্তিশালী করে এবং প্রসবকে সহজ করে তোলে। চিকিৎসকের পরামর্শে হালকা যোগব্যায়ামও করা যেতে পারে।
খ) স্কোয়াটিং ও কেগেল এক্সারসাইজ
এই ব্যায়ামগুলো প্রসবপথকে প্রস্তুত করে এবং গর্ভকালীন মলাশয় ও মূত্রথলির ওপর চাপ কমায়।
গ) মানসিক প্রস্তুতি ও ধ্যান
নরমাল ডেলিভারির জন্য ভয় দূর করা, সঠিক তথ্য জানা এবং মেডিটেশন বা গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস চর্চা করলে মস্তিষ্কের কর্টিসল হরমোন কমে এবং ডেলিভারি সহজ হয়।
ঘ) পর্যাপ্ত ঘুম
প্রতিদিন ৭–৮ ঘণ্টা ঘুম শরীরকে বিশ্রাম দেয় ও হরমোন নিয়ন্ত্রণে রাখে, যা নরমাল ডেলিভারির সহায়ক।
৩. ডেলিভারির পরবর্তী করণীয়-
শুধু সন্তান প্রসব করলেই দায়িত্ব শেষ নয়—বরং শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়।
ক) মায়ের পুষ্টি ও বিশ্রাম
সন্তান প্রসবের পরে মায়ের শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই ঘি, খিচুড়ি, রসুন সেদ্ধ, পায়েস, মাছ, ডিম, সবজি ইত্যাদি উচ্চপুষ্টিসম্পন্ন খাবার নিয়মিত খেতে হবে। পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম নিশ্চিত করতে হবে।
খ) শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো
জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যেই শিশুকে বুকের দুধ দেওয়া জরুরি। প্রথম দুধে ‘কলস্ট্রাম’ থাকে, যা শিশুর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে। পরবর্তী ৬ মাস কেবল বুকের দুধই যথেষ্ট।
গ) জীবাণুমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা
শিশুর ঘর, বিছানা, খেলনা ও মায়ের হাত পরিষ্কার থাকা আবশ্যক। নবজাতক খুব সংবেদনশীল, তাই সাবধানতা জরুরি।
ঘ) নিয়মিত চিকিৎসক পরামর্শ
মায়ের ও শিশুর উভয়ের জন্য নিয়মিত চেকআপ করা জরুরি। টিকাদান সময়মতো করাতে হবে।
৪. শিশুর ব্রেইন ডেভেলপমেন্টের গুরুত্ব-
একজন শিশুর মস্তিষ্কের ৮০% বিকাশ হয় জীবনের প্রথম তিন বছরে। এই সময় সঠিক যত্ন ও পুষ্টি তার জীবনের ভিত্তি নির্ধারণ করে।
ক) গর্ভাবস্থার সময় থেকেই শুরু
গর্ভাবস্থায় মা যদি ভালো পুষ্টি গ্রহণ করে, গানের মাধ্যমে সন্তানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে, ভালো বই পড়ে—তাহলে শিশুর ব্রেইন ডেভেলপমেন্টে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।
খ) জন্মের পর সাড়া দেওয়া
শিশু যখন কান্না করে বা হাসে, মা যদি তৎক্ষণাৎ সাড়া দেয়, তাহলে শিশুর স্নায়ু-সংযোগ (neural connections) দ্রুত গড়ে ওঠে।
গ) স্নেহ ও চুম্বকীয় বন্ধন
মায়ের কোলে থাকা, চোখে চোখে তাকানো, গায়ে গায়ে ঘষা—এইসব কার্যকলাপ শিশুর ব্রেইনকে উত্তেজিত করে এবং শেখার ক্ষমতা বাড়ায়।
ঘ) ভাষা ও গান
শিশুকে নিয়মিত গল্প বলা, গান গাওয়া, কথা বলা—এসবই শিশুর ভাষাশিক্ষা ও সৃজনশীলতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
ঙ) পর্যাপ্ত ঘুম
নবজাতকের জন্য প্রতিদিন ১৪–১৬ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন। ঘুমের সময়ই তার ব্রেইন সবচেয়ে দ্রুত বেড়ে ওঠে।
একজন মায়ের সঠিক পুষ্টি, শরীর ও মনের প্রস্তুতি এবং প্রসব-পরবর্তী যত্ন কেবল একটি শিশুর সুস্থ জন্মই নয়, তার ভবিষ্যতের মেধা ও মানসিক বিকাশকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করে। সচেতন মা মানেই এক নতুন সচেতন প্রজন্মের জন্ম। তাই গর্ভাবস্থা থেকে শুরু করে শিশুর প্রথম কয়েক বছর পর্যন্ত প্রতিটি পদক্ষেপেই চাই বিজ্ঞতা, ভালোবাসা ও যত্ন।